জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রত্যক্ষ করের হার না বাড়লেও জনগণকে টানতে হবে বাড়তি পরোক্ষ করের বোঝা। সেই কৌশল নিয়ে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের আয়ের লক্ষ্য ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এই বাজেটে জনগণের ঘাড়ে সরাসরি করের চাপ না বাড়লেও পরোক্ষ করের বোঝা বাড়বে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আয় তাড়া করতে গিয়ে পরোক্ষ করের চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে করপোরেট কর কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করেছেন তিনি। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে কাঁচামাল আমদানির শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশি মোবাইল ফোনসহ ইলেকট্রনিক খাতকে সুরক্ষা দিতে এসব পণ্যের আমাদানি পর্যায়ে সারচার্জ বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে বিড়ি, সিগারেট ও তামাক পণ্যের ওপর উচ্চ হারে বিদ্যমান কর বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের চাকরিজীবীদের স্বস্তি দিতে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর একটি রূপরেখাও ঘোষণা করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এদিকে আগের বারের মতো নতুন বাজেটেও নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন মিলিয়ে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে জনপ্রশাসন খাতে মোট বাজেটের ১৮ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিক্ষা, প্রযুক্তি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন খাতে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২ দশমিক ২ শতাংশ। গতকাল জাতীয় সংসদে ‘সমৃদ্ধ আগামী পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর আগে সকালে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পায়জামা পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিব কোট পরিহিত সদা হাস্যোজ্জ্বল অর্থমন্ত্রী সংসদ কক্ষে প্রবেশ করেন। তারপর দুপুর পৌনে ১টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। এটি আবুল মাল আবদুল মুহিতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে পেশ করা টানা ১০তম এবং ব্যক্তিগত ১২তম বাজেট। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট এটি। উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী বছর মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ অর্জিত হবে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। অন্যদিকে বছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখা সম্ভব হবে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী, সরকার ও বিরোধীদলীয় এমপি, সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, বিচারপতি, দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক ও দেশি-বিদেশি মেহমানরা উপস্থিত ছিলেন। বাজেট অধিবেশন ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাজেট উপস্থাপনা বাংলাদেশ টেলিভিশন ও সংসদ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করে। অন্যবার দাঁড়িয়ে বাজেট ঘোষণা করলেও এবার নিজ আসনে বসেই পাওয়ার পয়েন্ট পদ্ধতিতে বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন ও বাহবা জানান। সংসদের বাইরেও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এলইডি স্ক্রিনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। বাজেট বক্তৃতার মাঝামাঝি সময়ে ৩০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়।
বাজেট পরিসংখ্যান : আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মূল বাজেট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর, এনবিআর-বহির্ভূত কর, কর ব্যতীতপ্রাপ্তি ও সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব প্রাপ্তি ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে এটা করা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে ভ্যাট থেকে সংগ্রহের লক্ষ্য সর্বোচ্চ ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত ভ্যাট থেকে সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। আয়কর খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৭১৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। আর শুল্ক এবং অন্যান্য কর বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৮৪ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ৪৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক ৩২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক ৩৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের আগামী অর্থবছরের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ ব্যয় ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা ধরেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ২ লাখ ১০ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় করার পরিকল্পনা ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ ব্যয় এক লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বাজেট ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) আগামী অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, যা পরে করা হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৪১ কোটি টাকা।
জিডিপি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৫ দশমিক ৬ শতাংশ : আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি খাতের বিনিয়োগকে আরও চাঙ্গা করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এদিকে চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে নতুন অর্থবছরে তা ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি বাজারমূল্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছিল ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ভিতরে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়েছে তার মোট আর্থিক মূল্য এটি। আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার বেড়ে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাজেটে আয়ের খাত : প্রস্তাবিত বাজেটে এবারও আয়ের প্রধান খাত রাজস্ব। বিশাল ব্যয়ের বাজেটের অর্থের সংস্থান করতে অভ্যন্তরীণভাবেই। এবারের বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। ফলে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের টার্গেট ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৯৬ হজার ২০১ কোটি টাকা। চলতি বছর এ লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এর বাইরে কর ব্যতীত আয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত আয় ধরা হচ্ছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। আগামী বছর আশা করা হচ্ছে, বৈদেশিক অনুদান আসবে ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এই বাজেট বাস্তবায়নে একদিকে বিশাল অঙ্কের এই রাজস্ব আদায় করতে হবে সরকারকে। অন্যদিকে কর কাঠামোতে খুব একটা পরিবর্তন না আনলেও ভ্যাট আর পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এ ছাড়া বাজেটের বিশাল আকারের ঘাটতি অর্থায়ন করতে সরকার ব্যাংক খাতকে বেছে নিয়েছে প্রধান ঘাটতি অর্থায়নকারী হিসেবে। এ জন্য ব্যাংক থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অবশ্য চলতি বাজেটে ২৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা ১৯ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
ব্যয়ের খাত : এডিপি : নির্বাচন সামনে রেখে গ্রামীণ রাস্তাঘাট সংস্কারসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে চায় সরকার। এ জন্য আগামী বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে চার হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচিতে এক হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা, অন্যান্য স্কিমে ৩২৭ কোটি টাকাসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মোট এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে নতুন বাজেটে। বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের মূল বাজেটে এর পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে এক লাখ ৯৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে নতুন বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩০ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ২৪ হাজার ৮৭১ কোটি এবং সংশোধিত বাজেটে ১৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
বেড়েছে ভর্তুকি : নতুন বাজেটে ৩৩ হাজার ২০৫ কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে এবারের বাজেটে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এবার কৃষি খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ভর্তুকি ও প্রণোদনার প্রস্তাব করা হয়েছে ১৯ হাজার ৬০১ কোটি টাকা জনপ্রশাসন খাতে।
বাড়ল সামাজিক সুরক্ষার আওতা : প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা ও ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এ কর্মসূচির আওতায় দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসের ক্ষেত্রে নিয়মিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম হলো আমাদের অন্যতম হাতিয়ার। ‘অসচ্ছল, যুদ্ধাহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা অথবা নাতি-নাতনিদের সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রস্তুত করছে। এজন্য আগামী বাজেটে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৩৫ লাখ থেকে ৪০ লাখে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধবা ও স্বামী কর্তৃক নিগৃহীত মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ৬৫ হাজার থেকে ১৪ লাখে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বীরমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানী ভাতা ও উৎসব ভাতার পাশাপাশি বার্ষিক দুই হাজার টাকা হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা চালুকরণ, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিজয় দিবস উপলক্ষে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে বিশেষ সম্মানী ভাতা চালুকরণের প্রস্তাবও এবার এসেছে।
বাজেট ঘাটতি বেড়েছে : বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে প্রণয়ন করতে হচ্ছে আগামী বছরের বাজেট। নতুন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য বাজেটে ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। ওই অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
ঘোষিত নতুন এই বাজেটে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক উৎস থেকে মোট ৬০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তা থেকে আবার ১০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ করা হবে। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা। ঘাটতির বাকি ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে।
ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা : ঘাটতি অর্থায়নের অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংক খাতকে অন্যতম উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। অবশ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি অর্থ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয়। যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবনা অনুযায়ী সরকার এ বছর ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উৎস হতে নেওয়া হবে।
সার্বজনীন পেনশন চালুর প্রস্তাব : সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের চাকরিজীবীদের অবসরকালীন সুবিধা ও স্বস্তি দিতে সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারি খাতের ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ পেনশনের আওতায় রয়েছে। এর বাইরে আরও ৩৫ লাখ হতদরিদ্র মানুষ মাসিক ৪০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ বয়স্ক। প্রতিনিয়ত এর সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে এবং বৈষম্য কমাতে চাই। বিদ্যমান সরকারি পেনশন কার্যক্রমের বেসরকারি আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত সব কর্মজীবী মানুষের জন্য সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে চাই। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মজীবী মাসিক ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা জমা করবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক কর্মজীবী পেনশন হিসেবে জমা করবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে গঠিত তহবিল বিনিয়োগ হতে প্রাপ্ত আয় সার্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা হতে থাকবে। এভাবে অন্ততপক্ষে কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার ইচ্ছা রয়েছে সরকারের।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিস্ময় : অর্থমন্ত্রী : ১৫৬ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উপসংহারে বলেছেন, বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও বাজেটের আকার বেড়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি পেতে হলে এর কোনো বিকল্পও নেই। এ বছরের সংশোধিত বাজেট বাস্তবায়নের হার আবার ৯২ শতাংশ হবে বলে আশা করে তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগামীতে সরকার অনেক ভালো অবস্থানে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারী আমি। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ৪৭ বছর পূর্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম একটি ‘সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সোনার বাংলা’ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে। বিগত ১০টি বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সুবাদে সে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের প্রয়াস নিয়েছি। আজ দেশে/বিদেশে সবাই স্বীকার করে, এ ১০ বছরে দেশ অনেকখানি এগিয়েছে। তবু স্বপ্নের সীমারেখা এখনো স্পর্শ করা যায়নি। এটি নিরন্তর বহমান একটি প্রক্রিয়া। সব মিলিয়ে দেশকে কতটা দিতে পেরেছি তার মূল্যায়ন দেশবাসী আর বিশ্ব করছে। তবে এটুকু দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি, আমার মননে ও কর্মে আমি কেবল আমার দেশের অগ্রযাত্রাকেই বিবেচনায় রেখেছি। বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা আমাকে বিস্মিত ও স্বপ্নচারী করে। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি, কতটা আঘাত সহ্য করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এদেশের জনগণ, স্বল্প সম্পদ ও সীমাহীন সীমাবদ্ধতার মাঝে ‘বাস্কেট কেস’ এর অপবাদ কাটিয়ে একটি দেশ কীভাবে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হয়ে ওঠে। যে দেশের শ্রমবাজারে আছে ২ কোটিরও অধিক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী, যে দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো প্রত্যন্ত গ্রাম-পাড়া-মহল্লা এমনি দুর্গম পার্বত্য এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে অমিত সমুদ্র সম্পদ, প্রতিনিয়ত যেখানে উন্মোচিত হচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার এবং যে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ১৬ কোটি স্বতঃস্ফূর্ত জনগণ সে দেশের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত বা প্রতিরোধ করার সাধ্য কারও নেই। এখন প্রয়োজন কেবল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব কিছুর সুসমন্বয় এবং সঠিক ও সুযোগ্য নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা। সমৃদ্ধ আগামীর পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রার ‘রূপকল্প-২০৪১’ প্রণয়নে আমি বয়সের কারণেই হয়তো তেমন ভূমিকা রাখতে পারব না; তবে কাজ যে শুরু হয়েছে তাতে আমি খুবই তৃপ্ত ও নিশ্চিত। অবশ্যই সে উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার চেষ্টা করব। এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে এবং সমৃদ্ধ আগামীর পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় দৃঢ় বিশ্বাস ঘোষণা করে আমি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট এ মহান সংসদে পেশ করছি। আমি নিশ্চিত এ বাজেট বাস্তবায়নে দেশের জনগণ তাদের উদ্যোগ, সৃজনশীলতা, কর্মদক্ষতা, অংশীদারিত্ব এবং সর্বোতভাবে স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে অংশগ্রহণ করবে। প্রথা অনুযায়ী আজ শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দুপুর আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থমন্ত্রী। জাতীয় সংসদে দীর্ঘ আলোচনার পর আগামী ২৮ জুন পাস করা হবে এই বাজেট।
করপোরেট কর কমল ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের : বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিতে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি অন্যান্য কোম্পানির করপোরেট করহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, ‘অনেকে বলেন, আমাদের দেশে করপোরেট করহার সবচেয়ে বেশি। কথাটি ঠিক নয়। তবে ব্যাংকিং খাতের করহার কিছুটা বেশি হওয়ায় এটা কমানোর প্রস্তাব করছি। এতে রাজস্ব কিছুটা কমলেও বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা যাবে।’ গতকাল সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল অপারেটর ও তামাক কোম্পানিগুলোর জন্য সর্বোচ্চ করপোরেট কর নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির বিদ্যমান করহার ২৫ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশ কম। এ ছাড়া আমাদের করহার বৈশ্বিক গড়হারের ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা সঙ্গতিপূর্ণ। মোটামুটিভাবে বর্তমানে সর্বোচ্চ করহার হবে বাস্তবে ৪০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় হারটি হবে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। করপোরেট করহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির বতর্মানে কর ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা আছে, যা আগামী অর্থবছরেও অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে নন-পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির জন্য বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ করও অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাবলিকলি ট্রেডেড ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকার কর্তৃক ২০১৩ সালে অনুমোদিত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান ৪০ শতাংশ করপোরেট কর কমিয়ে ৩৭.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে কমানোর কথা বলা হয়েছে নন-পাবলিকলি ট্রেডেড ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর। এ খাতের বিদ্যমান ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট কর থেকে পরিবর্তন করে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত করপোরেট কর চলতি অর্থবছরের মতো ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির জন্য ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর। মোবাইলফোন অপারেট কোম্পানির মধ্যে পাবলিকলি ট্রেডেড হলে ৪০ শতাংশ, নন-পাবলিকলি ট্রেডেড হলে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে লভ্যাংশ আয়ের ২০ শতাংশ।
ভোটের বছরে বরাদ্দ বাড়ল ইসির : সংসদ নির্বাচনের বছরে বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে নির্বাচন কমিশনের। নতুন অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে ১ হাজার ৮৯৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ দাঁড়ায় ৯৫৩ কোটি টাকা। গতকাল জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রস্তাবিত বাজেটে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জন্য পরিচালন খাতে ১ হাজার ৬৮৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ও উন্নয়ন খাতে ২১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বরাদ্দ পাওয়া অর্থে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ, জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন, বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের সাধারণ ও উপনির্বাচন, উন্নতমানের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য যাচাই অব্যাহত রাখা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা রয়েছে। তবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়নি। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯-এর ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নতুন অর্থবছরে গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে উপজেলা নির্বাচন হবে। এ ছাড়া পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন এবং সংসদ-স্থানীয় সরকারের উপনির্বাচন রয়েছে।
আইসিটি খাতের বিকাশে ৫% শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব : আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সেলুলার ফোন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কতিপয় কাঁচামালে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করছি। একই সঙ্গে দেশে তৈরি হয় না এমন সফটওয়্যার যেমন—ডাটাবেজ, প্রোডাক্টিভিটি সফটওয়্যার আমদানিতে শুল্ক সর্বক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হ্রাসের প্রস্তাব করছি। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বিগত অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে সেলুলার ফোন উৎপাদন ও সংযোজনে রেয়াতি সুবিধা প্রদানের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান সেলুলার ফোন উৎপাদন ও সংযোজন শুরু করেছে। তাই এক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব এই খাতকে এগিয়ে নেবে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সরকারের অন্যতম উন্নয়ন কৌশল। এ লক্ষ্যে ভিশন-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আইসিটি খাতের পণ্যে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উেক্ষপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্প্রতি স্যাটেলাইট দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে। সেলুলার ফোন আইসিটি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
জ্বালানির চেয়ে ১১ গুণ বেশি বরাদ্দ বিদ্যুতে : এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৪ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছর থেকে এবার এই খাতে ৬৬১ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবের প্রায় পুরো টাকাই বিদ্যুৎ খাতে রাখার কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে বিদ্যুতে ২২ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা আর জ্বালানিতে মাত্র এক হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জ্বালানির চেয়ে এবার বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ১১ গুণের বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে চলতি বছরের তুলনায় ১৮-১৯ অর্থবছরে জ্বালানিতে বেশি বরাদ্দ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ২০১৭-১৮ সালে বরাদ্দ ছিল ২২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এবার ১১৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। আর জ্বালানিতে ২০১৭-১৮ সালে ছিল এক হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এবার জ্বালানি খাতে ৫৪৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
করের আওতায় আসবে গুগল ইউটিউব ফেসবুক : প্রস্তাবিত বাজেটে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবকে করের আওতায় আনা, ই-কমার্সে ভ্যাট আরোপসহ বেশকিছু প্রস্তাব এসেছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রচুর আয় করছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা তেমন একটা কর পাচ্ছি না। ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল লেনদেনের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে নতুন বিধায় এসব লেনদেনকে করের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত বিধান এতদিন আমাদের কর আইনে ছিল না। আমি ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল খাত যেমন ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব ইত্যাদির বাংলাদেশ থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর আরোপের জন্য আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে প্রয়োজনীয় আইনি বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করছি। এর ফলে করের আওতা বাড়বে। এই আলোকে বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবার ওপর সাড়ে ৪ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে যেসব সেবা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে, তাদের কর দিতে হবে বেশি। অর্থাৎ গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর যেসব ব্যবসা রয়েছে, সব কটি করের আওতায় চলে আসবে। এমনকি দেশে বিকাশমান রাইড শেয়ারিং সেবাগুলো এর আওতায় আসবে। এ ছাড়া চলতি বছরের বাজেট অধিবেশনে ভার্চুয়াল ব্যবসায় ৫ শতাংশ হারে কর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, বর্তমানে ইন্টারনেট বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বেড়েছে। এ পণ্য বা সেবার পরিসরকে আরও বাড়াতে ভার্চুয়াল বিজনেস নামের আরেকটি সেবার সংজ্ঞা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে অনলাইনভিত্তিক যে কোনো পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরকে এ সেবার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
তৈরি পোশাকে কর বাড়ল : নতুন বাজেটে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তৈরি পোশাকের সাধারণ কারখানার করহার ১৫ ও তৈরি পোশাকের তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে গত বছর একক আয়কর হার ছিল ১২ শতাংশ। অন্যদিকে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবেশসম্মত ভবন সনদ (গ্রিন বিল্ডিং সার্টিফিকেশন) আছে এমন সবুজ কারখানার আয়কর হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। মুহিত বলেন, দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে তৈরি পোশাক খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে এ খাতকে বিশেষ কর সুবিধা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের পণ্যের রপ্তানি মূল্যের ওপর উেস করহার আগের বছরের মতোই দশমিক ৭ শতাংশ বহাল রাখা হয়েছে।
বাজেটে পুরনো ফ্ল্যাট নিবন্ধনে ২ শতাংশ মূসক : প্রস্তাবিত বাজেটে পুরনো ফ্ল্যাট পুনরায় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ হারে মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে প্রযোজ্য ৯টি সংকুচিত ভিত্তিমূল্য কমিয়ে পাঁচটিতে নামিয়ে আনারও প্রস্তাব করা হয়। গতকাল বাজেট বক্তৃতায় আবাসন খাতে ১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাটে ২ শতাংশ হারে, ১৬০১ বর্গফুটের ওপর ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ৪.৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপের প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। চলতি বাজেটে ১১০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে দেড় শতাংশ, ১১০১-১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত আড়াই শতাংশ হারে এবং ১৬০১ বর্গফুট থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে মূসক আরোপ আছে। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, ১ থেকে ১১০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে মূসক বাড়ল আবার ১১০১ থেকে ১৬০০ বর্গফুট পর্যন্ত ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে মূসক কমল।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে : ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৬৫ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এ খাতে ৬৭ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে বেসরকারি শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট ও ভাতার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বিপরীতে মোট ৫৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। খাতভিত্তিক বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ২২ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক ওয়াশব্লকসহ সাত হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ, ৬৫ হজার শ্রেণিকক্ষ, ১০ হাজার ৫০০ শিক্ষক কক্ষ, ৫ হাজার বিদ্যালয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও ৩০ হাজার খেলার সামগ্রী বিতরণ করা হবে। বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় আরও এক হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষার স্বার্থে ‘সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২০০ সরকারি কলেজে প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থী ও ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ৩২৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৩ লাখ ২৯ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। চারটি বিভাগীয় শহরে চারটি মহিলা পলিটেকনিক, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে গার্লস টেকনিক্যাল স্কুল, ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং সব বিভাগে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করা হবে। দেশের ৬৫৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাসহ ২৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪৬ হাজার ৩৪০টি মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ এবং দুই হাজার ১২০টি স্মার্ট শ্রেণিকক্ষ তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতেও বরাদ্দ থাকছে বাজেটে। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সব ইউনিয়ন ও কয়েকটি শহরে আইসিটি বেইজড কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হবে। দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি জীবিকায়ন ও জীবনব্যাপী শিখনকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। শিক্ষকদের জন্য চলমান প্রশিক্ষণের বাইরে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ এবং ছাত্রদের জন্য গণিত অলিম্পিয়াডের কৌশল প্রয়োগ করে গণিতভীতি দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে সব বোর্ডে সমন্বিত উদ্যোগে প্রশ্নব্যাংক তৈরির করার কথাও বলা হয়েছে বাজেটে। উপবৃত্তি, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম ইত্যাদির পরিধি বাড়বে এ বাজেটে।
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া : ২০১৮-২০১৯ সালের প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘ভোটার আকৃষ্ট করার বাজেট’ বলে মন্তব্য করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা বলেছে, এ বাজেট বুলিসর্বস্ব, ফাঁপা ও অবাস্তবায়নযোগ্য। এই বাজেট ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য ও ভোগ বৈষম্য বাড়াবে। স্বল্পসংখ্যক লোকের হাতে অর্থ ও সম্পদ পুঞ্জীভূত হবে। দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হবে। এ বাজেটকে লুটেরা ধনিক শ্রেণির দলিল হিসেবেও উল্লেখ করে কোনো কোনো দল।
জেএসডি : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার চটকদারি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। রাজনীতি, রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সরকারের দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। গতকাল দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (দফতর ব্যবস্থাপনা) এস এম আনছার উদ্দিন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে তারা এ কথা বলেন।
নাগরিক ঐক্য : ২০১৮-১৯ সালের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে এক লিখিত প্রতিক্রিয়া দিয়েছে নাগরিক ঐক্য। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অবিশ্বাস্যভাবে রাজস্ব সংগ্রহে প্রত্যক্ষ কর, আয়করের হিস্সা গত বছরের তুলনায় সামান্য হলেও কমেছে। অথচ এটা হওয়া উচিত মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের অন্তত ৫০%। সক্ষম মানুষকে করের আওতায় না এনে পরোক্ষ কর বেশি রাখা মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে। আয়কর মুক্ত আয়ের সর্বোচ্চ সীমা আগের মতোই ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় রাখাটা ভীষণ অযৌক্তিক। বিদ্যমান দারিদ্র্যসীমায় (এক ব্যক্তির দৈনিক ১.৯ ডলারের নিচে জীবনযাপন) বসবাসকারী ৫ সদস্যের একটা পরিবারের মাসিক আয় হয় ২৪ হাজার টাকার নিচে। অথচ এমন একটা পরিবারের একক উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মাসে ২০ হাজার ৮৩৩ টাকার বেশি উপার্জন করলেই তাকে আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ সরকার দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের ওপর আয়কর চাপিয়ে দিচ্ছে!
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম প্রস্তাবিত বাজেটকে চটকদার ও গণপ্রতারণামূলক বলে আখ্যা দিয়েছেন। গতকাল এক যুক্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘এই বাজেট লুটেরা ধনী ব্যক্তিদের আরও ধনী করবে। ৯৯ ভাগ গরিব ও মধ্যবিত্তকে আরও দরিদ্র ও আর্থিকভাবে অসহায় করে তুলবে। ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার গণবিরোধী দলিল এই বাজেট। আমরা এই বাজেট প্রত্যাখ্যান করছি।’ বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, ‘বাজেট প্রস্তাবের ভিত্তি হলো পুঁজিবাদের নয়া উদারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন। এই বাজেটে সমাজতন্ত্রসহ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির কোনো প্রতিফলন নেই। শুধু তাই নয়, প্রস্তাবিত বাজেটে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী আদর্শে প্রণীত হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ কর প্রত্যক্ষ করের দিগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি : বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক বিবৃতিতে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট ‘বুলিসর্বস্ব, ফাঁপা ও অবাস্তবায়নযোগ্য’। এই বাজেট ধনী-গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য ও ভোগ বৈষম্য আরও বৃদ্ধি করে স্বল্পসংখ্যক লোকের হাতে অর্থ ও সম্পদ পুঞ্জীভূত করবে।
বাংলাদেশ ন্যাপ : প্রস্তাবিত বাজেট ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ। দলটির দাবি, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তাবিত বাজেটে লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাজেট উপস্থাপনের পর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, সরকার অবাস্তব ও গরিব ধ্বংসের বাজেট ঘোষণা করেছে।
খেলাফত মজলিস : প্রস্তাবিত বাজেটকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার বাজেট বলে দাবি করেছে খেলাফত মজলিস। দলটির আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেট গণবিরোধী। এতে সাধারণ জনগণের কোনো কল্যাণ হবে না। তারা বলেন, এ বাজেটে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার বিশাল অংকের ঘাটতি রয়েছে যা মেটাতে দেশ-বিদেশ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে সরকারকে।